News Breaking
Live
wb_sunny

Breaking News

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

 বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

ভাষা মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, বরং সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলা ভাষা, যা আমাদের মাতৃভাষা, তার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং জটিল। এই ভাষা আজকের অবস্থানে একদিনে আসেনি। বহু ভাষার সংমিশ্রণ, ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আজকের রূপ লাভ করেছে। এই নিবন্ধে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।


ভাষার উৎপত্তি: একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

ভাষা গবেষকদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বছর আগে মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে জানা যায়, আফ্রিকার মানুষেরাই সর্বপ্রথম ভাষার ব্যবহার করেছিল। গবেষকদের ধারণা, বর্তমান পৃথিবীর যত মৃত বা জীবিত ভাষা আছে, সেসবের আদি উৎস হলো আফ্রিকার ঐসব প্রাচীন মানুষদের ভাষা। আফ্রিকা থেকে যখন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন তাদের আদি ভাষাও বদলাতে শুরু করে। সেই ভাষা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে জন্ম হয় আরো নতুন নতুন ভাষার। এভাবে পৃথিবীর ভাষাগুলোকে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেমন: ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী, অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠী, আফ্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠী, চীনা-তিব্বতি ভাষাগোষ্ঠী, মালয়-পলিনেশীয় ভাষাগোষ্ঠী, নাইজার-কঙ্গো ভাষাগোষ্ঠী, দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠী ইত্যাদি। একটি ভাষাগোষ্ঠীর সব ভাষা এক পরিবারভুক্ত। আর সব ভাষাগোষ্ঠীই একটি মহাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আর তা হলো আফ্রিকার সেই আদিম ভাষা।


বাংলা ভাষার উৎপত্তি: ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে বাংলা


বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক হাজার বছর আগে। তখন ভারতের প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হতো প্রাচীন আর্য ভাষা। আনুমানিক ৪০০০ থেকে ১০০০ বছর আগে প্রোটো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা মধ্য-এশিয়ার জনগোষ্ঠী পশ্চিম আর পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, আর তাদের ভাষাও বিভিন্ন শাখার সৃষ্টি করে। এরই একটি শাখা হলো ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠী। আর ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর একটি শাখা ইন্দো-আর্য বা ভারতীয়-আর্য ভাষা।


ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী


ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পরিধি ছিল ইউরোপ থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলত, ইন্দো বলতে ভারতীয় উপমহাদেশ, এবং ইউরোপীয় বলতে ইউরোপ মহাদেশকে বোঝায়। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এই পরিবারের ভাষাগুলোতে কথা বলে থাকে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাসহ, হিন্দি, নেপালি, ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, ফারসি, ফরাসি, ডাচ ইত্যাদি ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুটি ভূখণ্ডে বিভক্ত হওয়ার কারণে এই ভাষাগোষ্ঠীকে দুটি শাখাতে ভাগ করা হয়: শতম ও কেন্তুম। শতম শাখাটি থেকে ভারতের, আর কেন্তুম শাখা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা এসেছে।


ভারতীয় আর্যভাষা


ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্তরটির নাম হলো বৈদিক ভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ। এই আর্যভাষা উঁচু গোত্রের মানুষদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য মনে হতো। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে পন্ডিতরাও এটি ব্যবহার করতেন। বেদের শ্লোকগুলোও এই ভাষায় লেখা হয়েছিল।

তারপরের স্তর হলো সংস্কৃত ভাষা, যার সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ পর্যন্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়। বৈদিক ও সংস্কৃত এই দুই ভাষা হলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত কালিদাসের কাব্য ও নাটকের ভাষা ছিল সংস্কৃত। রামায়ণ ও মহাভারতও সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হয়েছিল। এমনকি, এখনও সংস্কৃত ভাষা ভারতে ব্যাপকভাবে পঠিত এবং একটি পবিত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।


এর পরের স্তর প্রাকৃত ভাষা। এই ভাষাগুলো মধ্যভারতীয় আর্যভাষা হিসেবে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষাগুলোই কথ্য ও লিখিত ভাষা হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। ধারণা করা হয়, প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টের জন্মেরও কমপক্ষে ছয়শ বছর আগে। সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। সংস্কৃতের মতো পালিরও মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দী আগেই। অর্থাৎ, এখন আর এই ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সেই অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এই ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূলত, একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। ফলে এই ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।


এই প্রাকৃত ভাষাগুলো থেকে অপভ্রংশ বা বিকৃত হয়ে বিভিন্ন ভাষা, যেমন: বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি প্রভৃতির জন্ম। সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে সর্বপ্রথম ‘অপভ্রংশ’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিছু অশিষ্ট শব্দকে নির্দেশ করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বর্তমান ভাষাবিদদের মতে, সমস্ত প্রাকৃত ভাষারই শেষ স্তর হলো অপভ্রংশ, এবং এই অপভ্রংশগুলো থেকেই সমস্ত নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার জন্ম। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল, এবং সেই পূর্বী অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী- এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া- এই তিনটি গৌড়ীয় ভাষার উৎপত্তি ঘটে। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।


বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশ


বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশকে তিনটি প্রধান যুগে ভাগ করা যায়: প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ।

প্রাচীনযুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)

প্রাচীনযুগ

বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। এটি পাল আমলে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। চর্যাপদ মূলত বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনসঙ্গীত, যা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপকে ধারণ করে। চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা ভাষার একটি রূপ, যা অপভ্রংশ ভাষার সাথে মিলে যায়।


মধ্যযুগ (১২০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)

মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে বাংলা ভাষায় মুসলিম শাসকদের প্রভাবে ফারসি, আরবি ও তুর্কি শব্দের প্রবেশ ঘটে। এছাড়া এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে ধর্মীয় ও লৌকিক বিষয়বস্তু প্রাধান্য পায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, এবং নাথ সাহিত্য এই যুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম।


আধুনিক যুগ (১৮০০-বর্তমান)


আধুনিক যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটে এবং বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। এছাড়া এই সময়ে বাংলা ভাষায় ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।


বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ


বাংলা ভাষা আজ বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বাধিক কথ্য ভাষা। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। তবে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলা ভাষায় ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা ও সংরক্ষণের অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে। বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা, গবেষণা ও প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার সাথে যুক্ত করতে হবে এবং বাংলা ভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

Tags

Newsletter Signup

Sed ut perspiciatis unde omnis iste natus error sit voluptatem accusantium doloremque.

Post a Comment