যুগ সন্ধিকালের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্যকীর্তি

 যুগ সন্ধিকালের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাহিত্যকীর্তি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু কবি এমনভাবে সাহিত্যচর্চা করেছেন, যাদের রচনা একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সেই একাধিকারী কবি, যাকে 'যুগ সন্ধিকালের কবি' বলা হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলার মধ্যযুগীয় কাব্যধারাকে ছাড়িয়ে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

কিন্তু কেন তাঁকে 'যুগ সন্ধিকালের কবি' বলা হয়, সেটি বুঝতে হলে তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং সমাজচেতনার গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

কেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে 'যুগ সন্ধিকালের কবি' বলা হয় ?

১. মধ্যযুগ থেকে আধুনিকতার দিকে পা বাড়ানো

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম ১৮০৮ সালে। তিনি বাংলা কাব্য সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনশীল সময়ের কবি। ১৭৬০ সালে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষ পর্ব শুরু হয়। এরপর, ১৮০১ সাল থেকে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ধারাটি ধীরে ধীরে শুরু হলেও, প্রকৃত আধুনিকতা ১৮৬১ সালে 'মেঘনাদবধ' প্রকাশের আগে পর্যন্ত প্রায় দেখা যায়নি। এই সময়টাতে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার অনুসন্ধান চলছিল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় এই যুগান্তরের সময়ের উপস্থাপন করেছেন, আর তাই তাঁকে 'যুগ সন্ধিকালের কবি' বলা হয়।

২. কাব্যশৈলীতে পরিবর্তন

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় মধ্যযুগীয় দেবদেবীর কাহিনী ও পৌরাণিক বিষয়বস্তুর পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কবিতা রচনা শুরু করেন। তাঁর কবিতাগুলোর মধ্যে সমাজচেতনা, দেশাত্মবোধ, মানবিকতা ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যেখানে আগে বাংলা সাহিত্যে দেবতা, দেবী ও ঐতিহ্যগত কাহিনীর রাজত্ব ছিল, সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যক্তির জীবন ও সমাজকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখতে শুরু করেন।

৩. কবিয়াল ও শায়েরদের প্রভাব

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মধ্যযুগীয় কবিয়াল ও শায়েরদের প্রভাব স্পষ্ট। তিনি পয়ার এবং ত্রিপদী মাপের ছন্দ ব্যবহার করেছেন, যা ওই সময়ের বাংলা কবিতার প্রথা ছিল। এই শৈলী তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে, যেখানে আধুনিক কাব্যশৈলীর সুচনা হলেও, পুরনো কাব্যধারার কিছু চিহ্ন রয়ে গেছে।

৪. সমাজচেতনা ও দেশাত্মবোধের বিকাশ

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় সমাজের নানা সমস্যা ও দেশাত্মবোধের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় দেশের প্রতি প্রেম ও দায়িত্ববোধের কথা উঠে এসেছে, যা তাঁর সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। তিনি একদিকে সমাজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করেছেন, অন্যদিকে দেশপ্রেমের কথা বলেছেন, যা পরবর্তী সময়ের কবিদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে।

৫. মধ্যযুগের কাব্য বৈশিষ্ট্য ও আধুনিকতার সূচনা

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মধ্যযুগের কাব্য বৈশিষ্ট্য যেমন—ধর্মীয় ভাবনা, ঐতিহাসিক বিষয় এবং গীতিকার ঢং বজায় রেখেছেন, তেমনি আধুনিকতার জন্য তাঁর কবিতায় নতুন ভাবনা, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের মতো উপাদানও যোগ করেছেন। ফলে তাঁর কবিতা একদিকে যেমন পুরনো ধারা অনুসরণ করে, তেমনি আধুনিক যুগের সূচনা ঘটায়।

মধ্যযুগের কাব্য বৈশিষ্ট্য সমুহ 

উপসংহার

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় বাংলার কাব্যশিল্পে এক অনন্য পরিবর্তন ঘটে। তিনি শুধু এক নতুন কাব্যধারা সৃষ্টি করেননি, বরং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করেছেন। তাঁর কবিতার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, কিভাবে এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত হতে পারে একটি সাহিত্যধারা। তাই 'যুগ সন্ধিকালের কবি' হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নাম ইতিহাসে চিরকাল থাকবে।

Post a Comment

Previous Next

نموذج الاتصال

Telegram

Instagram

Twitter

WhatsApp

Contact